শনিবার   ০৪ অক্টোবর ২০২৫   আশ্বিন ১৯ ১৪৩২   ১১ রবিউস সানি ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১৯

রিজার্ভ নিয়ে কতটা স্বস্তিতে বাংলাদেশ? 

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ৪ অক্টোবর ২০২৫  

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ধরা হয় একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অন্যতম প্রধান সূচক। গত কয়েক বছর দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধারাবাহিক পতনের পর সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা স্বস্তিদায়ক অবস্থানে এসেছে।

বর্তমানে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ২৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া আইএমএফের কাছে প্রদর্শিত নিট ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে চার মাসের আমদানি দায় মেটানো সম্ভব। ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকার মানদণ্ডে বাংলাদেশ বর্তমানে তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক অবস্থানে রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এক যুগ আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছর পর, অর্থাৎ ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারে। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছায়। একই বছরের ৮ অক্টোবর প্রথমবারের মতো ৪০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেই ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট দেশ সর্বোচ্চ রিজার্ভের মাইলফলক স্পর্শ করে। ওইদিন রিজার্ভ দাঁড়ায় ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার ৮০৪ কোটি ডলার। তবে পরের বছর থেকে ডলার সংকট দেখা দেওয়ায় ধারাবাহিক পতন শুরু হয় রিজার্ভে।

বিগত দু-তিন বছরে রিজার্ভে যে পতন দেখা দিয়েছিল তা এখন থেমে গেছে। বর্তমানে ব্যবসায়ীরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছেন। মুদ্রাবিনিময় হার বাজারে ছেড়ে দেওয়া হলেও তা স্থিতিশীল রয়েছে, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। - চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো হেলাল আহমেদ জনি

অর্থবছরভিত্তিক হিসাবে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়নে। এরপর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায় রিজার্ভ। ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা সামান্য কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩২ দশমিক ৯৪ ও ৩২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। এরপর ২০১৯-২০ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ৩৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে লাফিয়ে ওঠে ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায় রিজার্ভ। তবে ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়নে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা নেমে যায় ৩১ বিলিয়ন ডলারে। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো হেলাল আহমেদ জনি জাগো নিউজকে বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দেশের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ আকর্ষণ, ঋণ পরিশোধ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিগত দু-তিন বছরে রিজার্ভে যে পতন দেখা দিয়েছিল তা এখন থেমে গেছে। বর্তমানে ব্যবসায়ীরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছেন। মুদ্রাবিনিময় হার বাজারে ছেড়ে দেওয়া হলেও তা স্থিতিশীল রয়েছে, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।

রেমিট্যান্সে সুবাতাস, বাড়ছে রিজার্ভ
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম আড়াই মাসে (জুলাই–২১ সেপ্টেম্বর) প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছে ৬৯৩ কোটি ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। শুধু জুলাই মাসেই এসেছে ২৪৭ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হয়নি, বরং উল্টো ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কিনছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

রিজার্ভকে টেকসই করতে হলে রপ্তানি আয়ের গতি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি প্রবাসী আয় আরও বৃদ্ধি এবং অবৈধ অর্থপাচার রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা এসেছে।

ঋণ পরিশোধের চাপ
প্রতি বছর বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক ঋণের দায় মেটাচ্ছে সরকার। চলতি অর্থবছরের শুরুতে যেখানে ২০২ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড় হয়েছে, সেখানে একই সময়ে ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ৪৪৬ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন ডলার। অর্থবছর শেষে এই অঙ্ক প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। তবে আশার কথা, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের এই চাপের মধ্যেও রিজার্ভকে ভারসাম্যে রাখতে সাহায্য করছে রেমিট্যান্সপ্রবাহ।

রিজার্ভের ধারাবাহিক পতনের কারণ
২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু পরবর্তীসময়ে হঠাৎ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, ভুয়া আমদানি বিল, হুন্ডি লেনদেন ও অবৈধ অর্থপাচারের কারণে ক্রমেই কমতে থাকে রিজার্ভ। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে রিজার্ভ নেমে আসে ২৫ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়ায় এখন তা আবারও ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

রিজার্ভের পতন থামানো গেছে, যা ভালো দিক। রেমিট্যান্স বাড়ায় বাজারে বেড়েছে ডলারের প্রবাহ। যেসব প্রতিষ্ঠানের আমদানি দায় বকেয়া রয়েছে, তারা বাজার থেকে ডলার কিনে পরিশোধ করছে। সহজ কথায়, সরকার টাকা দিয়েছে কিন্তু ডলার সরাসরি দেয়নি। - অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন

গত এক যুগে রিজার্ভের উত্থান-পতনের চিত্রও স্পষ্ট। ২০১৩ সালে যেখানে রিজার্ভ ছিল ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার, সেখান থেকে ২০২১ সালে তা পৌঁছে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে। পরবর্তীসময়ে ধারাবাহিক পতনের পর ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে মোট রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।


বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, বর্তমানে যে রিজার্ভ আছে তা দিয়ে চার মাসের আমদানি দায় মেটানো সম্ভব। এ অবস্থাকে সন্তোষজনক বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ কর্মকর্তা।

তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলেন, এখানেই থেমে গেলে চলবে না। রিজার্ভ টেকসই করতে হলে রপ্তানি আয়ের গতি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি প্রবাসী আয় আরও বৃদ্ধি এবং অবৈধ অর্থপাচার রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।


এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সাধারণত যদি তিন মাসের আমদানি দায় মেটানোর সক্ষমতা থাকে, সেটিকে খুব খারাপ বলা যায় না। রিজার্ভের পতন থামানো গেছে, যা ভালো দিক। আগে পেট্রোবাংলাসহ জ্বালানি খাতের বিল বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলারে পরিশোধ করা হতো। এখন তা আর হয়নি। রেমিট্যান্স বাড়ায় বাজারে বেড়েছে ডলারের প্রবাহ। যেসব প্রতিষ্ঠানের আমদানি দায় বকেয়া রয়েছে, তারা বাজার থেকে ডলার কিনে পরিশোধ করছে। সহজ কথায়, সরকার টাকা দিয়েছে কিন্তু ডলার সরাসরি দেয়নি।

এই বিভাগের আরো খবর